দখিনের খবর ডেস্ক ॥ বিশ্বের বিখ্যাত যত ভাষণ বিশ্বনেতারা দিয়েছিলেন, সবই ছিল লিখিত, পূর্ব প্রস্তুতকৃত ভাষণ। আর ৭ মার্চের ভাষণসহ বঙ্গবন্ধুর সকল ভাষণই ছিল সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত, উপস্থিত বক্তৃতা। তাঁর ভাষণ ছিল একজন নেতার দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি। যে যুদ্ধ এনে দিয়েছে বিজয়। বিজয়ের রূপরেখা ছিল তাঁর বক্তৃতায়-যা বাংলার সাত কোটি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দী হিসেবেই কাটাতে হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বারবার এই দুঃসহ নিসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনও অপোস করেননি। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেননি। তাঁর জীবনে জনগণ ছিল অন্তঃপ্রাণ। সাধারণ মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন-সোনার বাংলা গড়বেন- এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালী জাতির দিকনির্দেশনার অন্যতম অস্ত্র। ১৯৭১ সালের ওই দিনে ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া আঠারো মিনিটের এই ঐতিহাসিক ভাষণটি আজও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরতে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথমদিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার এবং নির্বাচন করা হয়েছিল জাতীয়সঙ্গীত। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত কবে দেবেন, সেজন্যই ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা। আন্দোলন এবং মানুষের আকাক্সক্ষা বিবেচনায় নিয়েই বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্র সমাবেশে ৭ মার্চ ভাষণ দেয়ার ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণাার মধ্য দিয়েই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। একদিকে আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারে চাপ ছিল। অন্যদিকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে ছাত্র নেতাদের একটা অংশ চাপ তৈরি করছিল। সার্বিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু আলোচনার পথ খোলা রেখেই ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেন। ৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। সামরিক শাসন তুলে নেয়া এবং সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি চারটি শর্তের ব্যাপারেই শুধু বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন- ‘তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে।’ ৭ মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিল না, অথচ শুনলে মনে হয় বঙ্গবন্ধু কবিতার ছন্দে ছন্দে ভাষণ দিচ্ছেন। আমরা জানি যে, ৭ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্রনেতাদের ভিড়। দুপুর দুটার দিকে তোফায়েল আহমেদ এবং প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকসহ তরুণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন জনসভার উদ্দেশে। এদিকে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সে সময় রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। সেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার পালা শেষ করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি এবং হাতাকাটা কালো কোট পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু সেই মঞ্চে একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। ৭ মার্চে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে। মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। ১৮ মিনিটের এই ভাষণে সবদিকই উঠে এসেছিল। যাতে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা না হয়, সেজন্য তিনি চারটি শর্ত দিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় নেননি। অন্যদিকে, এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালী জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। স্বাধীনতার বীজ তিনি বপন করেছিলেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা প্রদান করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকো।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত স্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নীরবতা। ভাষণ শেষে আবার স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি নির্যাতিত বাঙালীকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্যও বিতরণ করা হয়েছিল। যা তাজউদ্দীন আহমদের মাধ্যমে কিছুটা পরিমার্জিত হয়েছিল। পরিমার্জনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবির ওপর গুরুত্বারোপ করা। ৭ মার্চের ভাষণের মূল কয়েকটি দিক হচ্ছে- ১। সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা, ২। নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা, ৩। পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত, ৪। সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহ্বান, ৫। অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলার হুমকি, ৬। দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং ৭। নিগ্রহ ও আক্রমণ প্রতিরোধের আহ্বান। বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত ও আলোচিত হতে থাকে ৭ মার্চের ভাষণ। এমনকি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয় ভাষণটি। নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এ ভাষণকে ‘ডকুমেন্টরি হেরিটেজ বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ ৭ মার্চের ভাষণ সংগৃহীত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা একে ‘ইতিহাসের প্রতিশোধ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। কারণ, স্বাধীন দেশে দীর্ঘ সময় এ ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। ২০১৫ সালে কানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল। তখন একাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও ২০১৭ সালে পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গার দায়িত্ব নেননি। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেই জনসভার ওপর হামলার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নিজের জীবনের সকল আরামআয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালী জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে বীর হিসেবে সম্মান দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বরং বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নকে সফল করেছেন।
Leave a Reply